Highlights

পেগাসাস কেলেঙ্কারি: দৃশ্যপটে ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী

Published

on

নিউজ ডেস্ক:
সাম্প্রতিক পেগাসাস কেলেঙ্কারির ঘটনায় স্পাইওয়্যারটির সঙ্গে সঙ্গে এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ-ও চলে এসেছে আলোচনায়। আর এই প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস ও কার্যক্রম খুঁজতে গেলেই বারবার চলে আসছে ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর নাম।

পেগাসাস নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড সাম্প্রতিক হলেও, গত এক দশকে এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির ও কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘনে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে একাধিকবার। পেগাসাস সফটওয়্যারটির উপর সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা নজর রাখছেন ২০১৬ সাল থেকে। বারবার সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ উঠে আসায় ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী প্রতিষ্ঠানটির ‘আঁতুরঘর’ কি না এমন সন্দেহও চলে আসছে।

এনএসও-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে অন্তত দু’জন ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক সদস্য। ২০১০ সালে এনএসও প্রতিষ্ঠা করেন নিভ কারমি, ওমরি লাভিয়ে এবং শালেভ হুলিও। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী লাভিয়ে এবং হুলিও এখনও আছেন এনএসও-র পরিচালনা পর্ষদে। ২০১৬ সালের ২৫ আগস্ট ফোর্বসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, লাভিয়ে ও হুলিও উভয়েই ইসরায়েলের ‘ইউনিট ৮২০০ সিগনালস ইন্টেলিজেন্স আর্ম’-এর সাবেক সদস্য। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইউনিট ৮২০০ ইসরায়েলের ‘ইন্টেলিজেন্স কোর’ এর একটি অংশ। সরাসরি ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইডিএফ ডিরেক্টরেট অফ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স-এর অধীনে কাজ করে এই বিভাগটি।

২০১৪ সালে আরেক ইসরায়েলি সার্ভেইলেন্স প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘সার্কলস’কে কিনে নেয় এনএসও গ্রুপ। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো মোবাইল ফোনের লোকেশন চিহ্নিত করার প্রযুক্তি আছে প্রতিষ্ঠানটির হাতে। বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশ সার্কলস-এর ক্রেতা ছিলো বলে জানায় ফোর্বস। এর প্রতিষ্ঠাতা টিল ডিলিয়ানও একজন সাবেক আইডিএফ কমান্ডার। ফোর্বসের প্রতিবেদনে সরাসরি ‘ইসরায়েলি স্পাই টিম’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে সার্কলের মূল কাণ্ডারীদের। মূলত সাইপ্রাস ও বুলগেরিয়া থেকে নিজেদের ব্যবসা চালাতো সার্কলস। বিভিন্ন সময়ে সংবাদকর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও সাইবার নিরাপত্তা গবেষকদের উপর নজরদারি চালানোর অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালে কানাডার সিটিজেন ল্যাবের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুলগেরিয়ায় সার্কলসের অফিস খোলা হয়েছিলো একটি ভুয়া ফোন কোম্পানির নামে।

বারবার সাইবার এসপিওনাজ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় ২০১৯ সালে সাইপ্রাস ও বুলগেরিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলো মানবাধিকার বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকসেস নাও’। এনএসও-এর কর্মাকাণ্ডকে জবাবদিহিতার অধীনে আনার অনুরোধ করেছিলো প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এনএসও-কে রপ্তানী লাইসেন্সই দেওয়া হয়নি বলে ব্যাখ্যা দেয় উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ।

দুই বছর আগে অস্বীকার করলেও চলতি বছরের ২০ জুন প্রকাশিত এক স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে তিনটি দেশ থেকে নিজেদের পণ্য রপ্তানী করার কথা বলেছে এনএসও। দেশ তিনটি হল, ইসরায়েল, বুলগেরিয়া ও সাইপ্রাস।

এ ছাড়াও, ২০১৬ সালে আইফোন হ্যাকিংয়ের অভিযোগ উঠেছিলো আরেক ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান সেলেব্রাইটের বিরুদ্ধে। ওই সময় এনএসও-র সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সখ্যতার কথা স্বীকার করেছিলেন সেলেব্রাইটের এক কর্মী।

এনএসও-র নিজস্ব ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে ‘সাইবার ইন্টেলিজেন্স ফর গ্লোবাল সিকিউরিটি অ্যান্ড স্ট্যাবিলিটি’। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তদন্ত ও প্রতিরোধ করতে বিভিন্ন দেশের সরকারকে সহযোগিতা করার দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবাদকর্মী এবং মানবাধিকার কর্মীদের উপর নজরদারি চালাতে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে এনএসও-র বিরুদ্ধে।

২০১২ সালে এনএসও-র সঙ্গে ২ কোটি ডলারের চুক্তি করে মেক্সিকো সরকার। পরবর্তীতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের তদন্তে উঠে আসে এনএসও-র তৈরি পণ্য ব্যবহার করে দেশটির সংবাদকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীদের উপর নজর রাখছে মেক্সিকো সরকার।

২০১৫ সালে পানামা সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে যায় এনএসও। পরবর্তীতে ইতালির এক প্রতিষ্ঠান থেকে গোপন ফাইল ফাঁস হয়ে গেলে পানামার দুর্নীতি বিরোধী তদন্তের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় ওই চুক্তি।

২০১৯ সাল পর্যন্ত সৌদি সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো প্রতিষ্ঠানটির। সাংবাদিক জামাল খাসোগজি হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর সৌদি সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্থগিত করে এনএসও।

অন্যদিকে গার্ডিয়ানের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কাতালোনিয়া স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের উপরে নজর রাখতে পেগাসাস ব্যবহার করেছে স্পেন সরকার।

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সিটিজেন ল্যাব এক প্রতিবেদনে জানায়, স্পাইওয়্যার সংক্রমণের কৌশল বদলে ফেলেছে এনএসও গ্রুপ। টেক্সট মেসেজ বা ইমেইলে ম্যালওয়্যার লিংক পাঠানোর বদলে, ‘জিরো-ক্লিক এক্সপ্লয়েট’ এবং নেটওয়ার্ক ভিত্তিক আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সমালোচক ও সংবাদকর্মীদের ফোনে আড়ি পাততে পেগাসাসের নতুন এই সংস্করণ ব্যবহার করেছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০টি দেশের ১৮০ জন সাংবাদিকের উপর নজরদারি চালানো হয়েছে এনএসও’র তৈরি পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করে।

সিটিজেন ল্যাব সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজি’র স্বজনদের ফোনে এনএসও-র পেগাসাস সংক্রমণের খবর জানিয়েছিল ২০১৮ সালের অক্টোবরে। খাসোগজির কাছের মানুষ ছিলেন সৌদি সরকারের কঠোর সমালোচক ওমর আবদুলআজিজ। তার ফোনে এনএসও-র পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করে নজর রাখা হচ্ছিল বলে নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটি। একই বছরের ডিসেম্বরে খাসোগজি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এনএসও-র পেগাসাসের পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিশ্চিত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

২০২০ সালে জুন মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, মরোক্কোর সাংবাদিক ওমর রাদির উপর নজর রাখতে এনএসও-র তৈরি পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে দেশটির সরকার। অন্তত তিনবার স্পাইওয়্যার আক্রমণ চালানো হয়েছে রাদির ফোনে। এর আগে ২০১৮ সালে সৌদি সরকার এনএসও গ্রুপের সহযোগিতা নিয়ে তাদের এক কর্মীর নজর রাখছিলো বলে অভিযোগ করেছিলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

শুধু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নয়, এনএসও-র গুপ্তচরবৃত্তির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছিলেন কানাডার সিটিজেন ল্যাবের গবেষকরাও। তবে, ওই ঘটনার সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছিলো এনএসও। বছর ঘুরতে না ঘুরতে, ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে এনএসও-র গুপ্তচর আহারন আলমগ-আসৌলিন’কে চিহ্নিত করে সিটিজেন ল্যাব। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আলমগ-আসৌলিনও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একজন সাবেক সদস্য।

প্রতিবেদন: বিডিনিউজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Trending

Exit mobile version